স্থাপত্য ও চিত্রকলা

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - মধ্যযুগের বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস | NCTB BOOK

মুসলমান শাসকগণ ইসলামের গৌরবকে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং নিজেদের শাসনকালকে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে অনেক প্রাসাদ, মসজিদ, কবর, দরপাহ ইত্যাদি নির্মাণ করেছিলেন। মসজিদ নির্মাণকে মুসলমান শাসকগণ অভিলয় পুণ্যের কাজ বলে বিবেচনা করতেন। সুলতানি আমলের স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এখনও অনেক স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে।    

   

স্বাধীন বাংলার মুসলমান সুলতানদের রাজধানী প্রথমে ছিল গৌড়, পরে পাওয়া এবং এরপর আবার গৌড়। কাজেই এ দুই শহরেই প্রথমে মুসলিম ঐতিহ্যের স্থাপত্য নিদর্শन উঠেছিল। ১৩৬৯ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান সিকান্দার শাহ 'আদিনা মসজিদ' নির্মাণ করেন। এ মসজিদের উত্তর পাশে সিকান্দার শাহের কবর নির্মিত হয়েছিল।       

     

বৰ্তমান ঢাকা থেকে ১৫ মাইল দূরে সোনারগারে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের একটি কবর আছে। এ কবরের অতি নিকটে পাঁচটি দরগাহ ও পাঁচটি মসজিদ আছে। এগুলো 'পাঁচ পীরের দরগাহ' নামে পরিচিত।   

 

সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সমাধি স্থাপত্যকলার একটি সুন্দর নিদর্শন। সুলতান জালালউদ্দিনের শাসনকালের উল্লেখযোগ্য কীৰ্ত্তি পাণ্ডুয়ার 'এক লাখি মসজিদ'। এর নির্মাণকাল ১৪১৮-১৪২৩ খ্রিষ্টাব্দ। প্রবাদ আছে যে, তখনকার দিনে এক লখ টাকা ব্যয়ে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তাই এটি 'এক লাখি মসজিদ' নামে পরিচিত হয়েছে। এ মসজিদ আসলে একটি কবর। এ সমাধি সৌধে তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রী-পুত্রদের সমাহিত করা হয়।       

 

বড় সোনামসজিদের আর এক নাম 'বারদুয়ারি মসজিদ'। এতে বৃহৎ বারোটি দরজা ছিল। এ মসজিদে সোনালি রঙের গিলটি করা কারুকার্য ছিল। সম্ভবত এজন্যই এটি সোনা মসজিদ নামে অভিহিত হতো। এ মসজিদটি গৌড়ের বৃহত্তম ম । আসাম বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য হুসেন শাহ এ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৫২৭ খ্রিষ্টান্সে নসরত শাহ এর নির্মাণ কাজ শেষ করেন।        

গৌড় শহরের দক্ষিণ প্রান্তে বর্তমান ফিরোজাবাদ গ্রামে 'ছোট সোনামসজিদ' নির্মিত হয়েছিল। এ মসজিদটি ছিল আকারে ছোট। তবে এ মসজিদেও সোনালি রঙের গিলটির কারুকার্য ছিল। সম্ভবত এ কারণেই এটি ছোট সোনামসজিদ নামে পরিচিত। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলে জনৈক ওয়ালি মুহম্মদ এটির নির্মাতা ছিলেন।   

 

বাগেরহাট জেলায় খান জাহান আলীর সমাধি নির্মিত হয়েছে। কিংবদন্তি অনুসারে খান জাহান আলী নামক জনৈক পির ঐ স্থানে বসতি স্থাপন করেন। ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি সুলতান নাসিরউদ্দীনের সমসাময়িক ছিলেন। 

    

বাগেরহাট জেলার ‘ষাটগম্বুজ মসজিদ' বাংলার মুসলমান শাসনকালের গৌরব বৃদ্ধি করেছে। খান জাহান আলীর সমাধির তিন মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে ষাটগম্বুজ মসজিদ অবস্থিত। অবশ্য এর গম্বুজ বাটটি নয়, সাতাত্তরটি। পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে এটি নির্মিত হয়েছিল। তুর্কি সেনাপতি ও ইসলামের একনিষ্ঠ সাধক উলুখ খান জাহান এ afer নির্মাণ করেন। এই স্থাপত্য কর্মটি জাতিসংগের ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বসভ্যতার নিদর্শন হিসেবে (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) স্বীকৃত হয়েছে।     

 

'কদম রসুল পৌড়ে অবস্থিত। মহানবির পদচিহ্নের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য এ ভবনটি নির্মিত হয়। নসরত শাহ এটি নির্মাণ করেছিলেন (১৫৩১ খ্রিষ্টাব্দ)। এ ভবনের এক কক্ষে একটি কালো কারুকার্যখচিত মর্মর বেদির উপরে হযরত মুহম্মদ (স) এর পদচিহ্ন সংবলিত একখণ্ড প্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল।   

 

ঢাকা জেলার রামপালে 'বাবা আদমের মসজিদ' অবস্থিত। ১৪৮৩ খ্রিষ্টাব্দে মালিক কাফুর ফতেহ শাহের রাজত্বকালে এটি নির্মিত হয়। এগুলোর বাইরেও বাংলার নানা স্থানে বহু মসজিদ ও সমাধি সৌধ আছে।

 

মসজিদ ও সমাধি সৌধ ছাড়াও এ যুগের নির্মিত বিভিন্ন তোরণ-কক্ষ ও মিনার মুসলমান বাংলার স্থাপত্য শিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এদের মধ্যে রুকনউদ্দিন বরবক শাহ নির্মিত গৌড়ের 'দাখিল দরওয়াজা' ও আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সমাধি-তোরণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গৌড়ের 'ফিরোজ মিনার' স্থাপত্য শিল্পের আর একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। অনেকে মনে করেন যে, যাৰসি সুলতান সাইফউদ্দিন ফিরোজ শাহ এটি নির্মাণ করেছিলেন।

                                                            

মুঘল আমলে বাংলার শাসকগণ শিল্পকলার ক্ষেত্রে এক বিস্ময়কর অবদান রেখে গেছেন। আজও বাংলার বহু স্থাে মুঘল শাসকগণের শিল্পপ্রীতির নিদর্শন বিদ্যমান রয়েছে। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু মসজিদ, সমাধি ভবন, স্মৃতিসৌধ, মাজার, দুর্গ, স্তম্ভ ও তোরণ নির্মিত হয়েছিল। স্থাপত্য শিল্পের বিকাশের জন্য এ যুগকে বাংলার মুঘলদের 'স্বর্ণযুগ' হিসেবে অভিহিত করা হয়।        

 

মুঘল যুগে 'কাটরা' নামে বেশ ক'টি দালান তৈরি করা হয়েছিল। এগুলো ছিল অতিথিশালা। ঢাকার বড় কাটরা' নির্মাণ করেন শাহ সুজা। এটি চকের দক্ষিণ দিকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত।   

 

নারায়ণগঞ্জ জেলার শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত হাজিগঞ্জ দুর্গ (বর্তমানে খিজিরপুর দুর্গ নামে পরিচিতি) সম্ভবত সুবাদার মির জুমলা (১৬৬০ - ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দ) এটি নির্মাণ করেন। মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এ দুর্গ তৈরি করা হয়েছিল।    

 

সুবাদার শাহজাদা আজম বেশ কিছু ইমারত তৈরি করেছিলেন। বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষে তিনি এক বিশাল কাটরা তৈরি করেছিলেন। তাঁর আমলেই 'লালবাগের শাহি মসজিদ তৈরি হয় ।      

 

বাংলায় মুঘল শিল্পকলার বিস্তারের ক্ষেত্রে শায়েস্তা খানের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খান ছোট কাটরা নির্মাণ করেন। এটি বড় কাটরা থেকে ২০০ গজ দূরে অবস্থিত । লালবাগের কেন্দ্রা আজও শায়েস্তা খানের শাসনকালকে স্মরণ করিয়ে দেয় । তাঁর শাসনকালের পূর্বেই এর নির্মাণ কাজ ত হয়। তিনি এটি শেষ করার পদক্ষেপ নেন। ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে ইব্রাহিম খানের শাসনকালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। লালবাগ দুর্গের ভেতর রয়েছে শায়েস্তা খানের কন্যা বিবি পরির সমাধি- সৌধ'। মার্বেল পাথরে নির্মিত এ সমাধি ভবনটি এখন পর্যন্ত এদেশে সর্বাধিক সুন্দর মুসলিম স্মৃতিসৌধ হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে শায়েস্তা খান হোসেনী দালান নির্মাণ করেন । চকবাজারের মসজিদ, বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত শায়েস্তা খানের মসজিদ ও সাতগম্বুজ মসজিদের সাথে শায়েস্তা খানের নাম জড়িয়ে আছে।

 

বাংলার নবাবদের সময়েও বহু ইমারত নির্মিত হয়। জিনজিরা প্রাসাদ তাঁদেরই কীর্তি। মুর্শিদ কুলি খানের আমলে বেগম বাজার মসজিদ নির্মিত হয় । মুর্শিদাবাদে তিনি একটি কাটরা ও মসজিদ নির্মাণ করেন। চেহেল ‘সেতুন' নামে একটি প্রাসাদও তাঁর সময়ে তৈরি। এটি ছিল একটি প্রকাণ্ড দরবার ভবন। এ সবান্ত স্থাপনা ছাড়াও মুঘল আমলে অনেক দুৰ্গ, ঈদগাহ, হাম্মামখানা, চিল্লাখানা ও সেতু নির্মাণ করা হয়। মুঘল যুগের এ সকল শিল্পকীর্তি বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল।

 

Content added || updated By
Promotion